কোনি(koni) মতি নন্দী রচিত -কোনি উপন্যাস download pdf (পর্ব-৭)

কোনি মতি নন্দী রচিত । দশম শ্রেণির বাংলা উপন্যাস। class x bangali Sahitya-Sonchayan ।। সাহিত্য সঞ্চয়ন দশম শ্রেণী উৎস সন্ধানে। koni download pdf by wb
18 min read

  

ছবি :- পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পাঠ্যপুস্তক 


                 লেখক-: মতি নন্দী      

      

লেখকের পরিচিত :- মতি নন্দী (১০ জুলাই ১৯৩১ - ৩ জানুয়ারি ২০১০) ছিলেন ভারতের কলকাতার একজন বাঙালি লেখক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মতি নন্দী ছিলেন মূলত ক্রীড়া সাংবাদিক এবং উপন্যাসিক ও শিশু সাহিত্যিক। তিনি আনন্দ পুরস্কার এবং সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। তার বিখ্যাত উপন্যাস 'কোনি'। লেখকের সম্বন্ধে আরো পড়ুন


না না না , কতবার বলব কনুইটা অতটা ভাঙবে না – হাতটা অমন তক্তার মতাে লাফিয়ে উঠল কেন ? উহু উহু ... হলাে না , বাঁ হাতটা এগােনাের সঙ্গে সঙ্গে বাঁ কাধটাও এগােচ্ছে আর ডান কাধটা পিছিয়ে যাচ্ছে , এতে স্কোয়ার শােল্ডার পােজিশানটা যে ভেঙে যাচ্ছে ...নে নে , আবার কর ... ওকি । জলের বাইরে হাত নিয়ে যাবার সময় শরীরের পাশের দিকটা বেঁকে তেউড়ে শুঁয়ােপােকা চলার মতাে হয়ে যাচ্ছে যে দ্যাখ !... আমাকে দ্যাখ । তাের কনুইটা কেন বাঁক খাচ্ছে না বােঝার চেষ্টা কর... এইভাবে , এইরকম । আর হাতের আঙ্গুল জল টানবার সময় ফাক করবি না । জলের ওপর থাবড় থাবড়ে হাত ফেলিস দেখেছি , ওভাবে নয় । পরিষ্কারভাবে সোঁত করে ঢুকে যাবে। আগে আঙুল তারপর কবজি থেকে পুরাে হাতটা । আর নিশ্বাস নেওয়াটা ভালাে করে বুঝোনে । যদি ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে নিশ্বাস নিস , তাহলে বা হাতটার কবজি যখন জলে ঢুকছে তখন মাথা ঘােরাবি । মাথা নীচু রাখার জন্য থুতনিটা বুকের দিকে টেনে রাখবি । মাথার লাইন এধার ওধার হবে না । ডান হাতটা যখন উঠবে তার তলা দিয়ে উকি দেবে হাঁ করে নিশ্বাস নিতে নিতে । আর ডান হাত যেই জলে ঢুকছে সেই সঙ্গে তাের মুখও আবার জলে ডুবছে ।... যা যা আবার কর । দু-হপ্তা হয়ে গেল এখনাে একটা জিনিসও ঠিক মতাে করতে পারলি না । ” 

জলের ধারে সিমেন্ট বাঁধানাে সরু পাড়ে দাঁড়িয়ে ক্ষিতীশ সমানে বকবক করে চলেছে । কোনি পাড়ের ধারে খানিকটা সাঁতরায় আর থেমে ওর দিকে তাকায় । সকাল সাড়ে ছ'টা থেকে এই ব্যাপার চলেছে । এখন সাড়ে আটটা । 

“ আর পাচ্ছি না ক্ষিদ্দা । ” 

“ কেন । বলেছিলি দু - দিনেই সুহাসের মতাে স্ট্রোক শিখে নিবি । দু - দিন ছেড়ে তো সতেরাে দিন হয়ে গেল । ” 

জলের মধ্যে দাঁড় সাঁতার কাটতে কাটতে কোনি চাপা রাগ নিয়ে বলল , " করছি তাে আমি । আপনি খালি হচ্ছে না হচ্ছে না । বলেই যাচ্ছেন । ”

 " না হলে কী বলব , হচ্ছে ? "

 “ হচ্ছেই তো । ” 

“ কিছু হয়নি । যা বলছি আবার কর । ” 

“ আমার ভালাে লাগছে না । ” 

কোনি পাড়ের দিকে এগিয়ে এল । ক্ষিতীশ কী করবে ভেবে না পেয়ে বলল , “ স্ট্রোক শিখলে কিন্তু নাইলন কস্টুম দেবাে । ” 

 “ দরকার নেই আমার । ” 

বাঁধানাে পাড়ে দু - হাতের ভারে কোনি জল থেকে উঠে এল । ক্ষিতীশ বুঝতে পেরেছে ওকে খাটাতে হলে জোরজবরদস্তিতে কাজ হবে না । কিছু একটা প্রাপ্তি যােগ না থাকলে ওকে উৎসাহিত করা যাবে না । 

“ উঠে পড়লি যে , ক্ষিদে পেয়েছে ? ” 

কোনি কথা বলল না । এগিয়ে গেল রেলিংয়ের গেট লক্ষ করে ।

“ ক্ষিদে তাে পাবেই । ভাবছি দুটো ডিম , দুটো কলা আর দুটো টোস্টের ব্যবস্থা করলে কেমন   হয় । ” 

কোনি দাঁড়িয়ে পড়েছে । ক্ষিতীশ মনে মনে হিসেব করে দেখল , প্রায় এক টাকার ধাক্কা । 

" আজ থেকে ? " 

ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়ল । কোনি কী যেন ভেবে নিয়ে বলল , “ আমি কিন্তু বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাব । ”

 ক্ষিতীশ একটু কৌতুহলী হয়েই বলল , “ বাড়িতে কেন ? ” 

“ এমনিই । বাহিরে আমি খাব না । ” 

“ তাহলে আরাে একঘণ্টা জলে থাকতে হবে । ”

 ক্ষিতীশ কথাটা বলেই মনে মনে ব্যথিত হলো । লােভ দেখিয়ে ক্ষুধায় অবসন্ন কোনিকে আরাে পরিশ্রম করানাে অমানুষিক কাজ হবে । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলাে সাধ্যের বাইরে গিয়ে নিজেকে ঠেলে নিয়ে যেতে হবেই , নয়তাে কিছুতেই সাধ্যটাকে বাড়ানাে যাবে না । খাটুক , আরাে খাটুক । যন্ত্রনায় ঝিমঝিম করবে শরীর , টলবে , লুটিয়ে পড়তে চাইবে যন্ত্রণার পাঁচিলের সামনে । আর তখন জেনেশুনেই চ্যালেঞ্জ দিতে হবে ওই পাঁচিলটাকে । এজন্য চরিত্র চাই , গোয়ার রোখ্ চাই । 

“... নাম নাম , দাঁড়িয়ে আছিস কেন । দুটো ডিম , দুটো কলা , দুটো মাখন টোস্ট । ” 

যন্ত্রণা কী জিনিস সেটা শেখ । যন্ত্রণার সঙ্গে পরিচয় না হলে , তাকে ব্যবহার করতে না শিখলে , লড়াই করে তাকে হারাতে না পারলে কোনােদিনই তুই উঠতে পারবি না । 

“ ...ঠিক আছে , ঠিক আছে , কনুই অতটা উঠবে না । মুখ ডুবিয়ে । ” 

যন্ত্রণা আর সময় তার অপােনেন্ট । ও দুটোকে আলাদা করা যায় না । যন্ত্রণাকে হারালে সময়কেও হারাতে পারবি । সময়কে হারালে পারবি যন্ত্রণাকে হারাতে । 

রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ক্ষিতীশ মনে মনে কোনির সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে । কমদিঘিতে এখন সাঁতার কাটছে একমাত্র কানি । মাঝখানের চওড়া ঘাট তিনচারজন বাইরের লােক স্নান করছে । বাসন ধুচ্ছে একটি স্ত্রীলােক । জুপিটার এবং অ্যাপােলাের নম্বর খােলা স্টার্টিং প্ল্যাটফর্মগুলাে পাশাপাশি প্রায় পাশ মিটারের ব্যবধানে । সেগুলাে এখন জনশূন্য । শুধু জুপিটারের স্প্রিং বাের্ড থেকে ঝাঁপ দিয়ে যাচ্ছে গােটাচারেক উটকো বাচ্চা ছেলে। জুপিটারের ক্লাবের বারান্দায় বেঞ্চে বসে দুটি লােক তেলে ভাজা খেতে খেতে গল্প করছে আর হাসাহাসি করছে ক্ষিতীশের দিকে তাকিয়ে ।

অ্যাপােলাে ক্লাবের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল অমিয়া আর বেলা । কোনির সাঁতার দেখতে তারা রেলিংয়ের ধারে দাঁড়ায় । অমিয়া দিন সাতেক পর আজ জলে নেমেছিল । কলেজের পরীক্ষার জন্য সে ব্যস্ত । অমিয়া না থাকলে বেলা নাকি ট্রেনিংয়ে জুত পায় না । দুজনে আজ আধ মাইল করে সাঁতরেছে । 

“ কে রে মেয়েটা ? ” অমিয়া জিজ্ঞাসা করল ।

“ ক্ষিদ্দার আবিষ্কার । ” বেলা চোখ পাকিয়ে বলল, “ শুনিসনি , হরিচরণদা কী বলছিল সেদিন ? ক্ষিন্দা নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে । জুপিটারকে ডাউন দেবে ওই মেয়েটাকে দিয়ে । ” 

“ সে কিরে , ও তাে এখনাে হাতের টান দিতেই শেখেনি ! সামনের বছরই আমি কিন্তু জুপিটারে ফিরে যাব । যেখানে ক্ষিদ্দা আছে সেখানে আমি নেই । পাঁচজনের সামনে ট্যাঁকোস ট্যাঁকোস করে কথা শােনাবে , ও আমার সহ্য হয় না । ” 

“ আমিও তাহলে যাব । ” 

দুজনে আর একবার কোনির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল । তখন আমি হেসে বলল , “ কম্পিটশনে পড়লে মেয়েটা তো আমার পা ধােয়া জল খাবে । ” 

প্রায় পৌনে দশটা । বাজার নিয়ে ফিরতে আজ দেরি হবেই । ক্ষিতীশ ব্যস্ত হয়ে হাঁটছে , পিছনে কোনি । একটা অস্টিন ফুটপাথ ঘেষে ক্ষিতীশের পাশে দাঁড়াল । জানালা দিয়ে বেরিয়ে এল বিষ্টু ধারের মুখ । 

“ ও ক্ষিতীশবাবু , আপনাকেই খুঁজছি যে । যে ইস্পিচটা লিখে দিলেন সেটা কেমন যেন ঠিক বাগে আনতে পাচ্ছি না , একটু ডিসকাসন করলে ভালাে হতাে । আজকেই তাে বিকেলে সভা । ” 

“ কিন্তু আমার যে এখুনি বাজার করে বাড়ি পৌঁছাতে হবে । ” 

“ গাড়িতে উঠুন । বাজার সেরে গাড়িতেই পৌছে দিয়ে ডিসকাসটা করে ফেলব । ” 

বিষ্টু ধর মােটরের দরজা খুলে দিল । ব্যস্ত হয়ে ক্ষিতীশ গাড়িতে উঠছে , তখন জামায় টান পড়ল।

 “ খাবারের কী হবে ! ” 

“ ওহ তাের ডিম - কলা । ” ক্ষিতীশ বিব্রত হয়ে , কী বলবে ভেবে পেল না । 

“ আমাকে বরং পয়সাটা দিয়ে দিন , কিনে নেব । ”

 কথা না বলে ক্ষিতীশ পকেট থেকে একটা টাকা বার করে কোনির হাতে দিয়ে বলল , “ বিকেলে ঠিক সময়ে আসিস । ” 

গাড়ি চলতে শুরু করলে বিষ্ঠু ধর জিজ্ঞাসা করল , “ কে মেয়েটা ? ” 

“ আমার ভবিষ্যৎ । ” ক্ষিতীশ হেসে বলল ।

লীলাবতী যথারীতি তালা দিয়ে বেরিয়ে গেছে ।

ক্ষিতীশ রান্নার উদ্যোগ না করে বিষ্টু ধরকে নিয়ে বারান্দায় বসল । বিশু আর খুশি এগিয়ে এল ক্ষিতীশকে দেখে । বিষ্টু কুঁকড়ে গিয়ে বলল , “ ও দুটোকে সরান । দেখলে গা শিরশির করে । ” 

বিড়াল দুটিকে ক্ষিতীশ ছােট্ট ধমক দিতেই ওরা বারান্দা থেকে নেমে গেল । 

“ দারুণ ট্রেনিং তাে । ” 

“ ওদের ভালােবাসি তাই কথা শােনে । ' ভালােবাসলে সবকিছু করিয়ে নেওয়া যায় , মানুষকে দিয়েও । ” 

“ তার মানে মানুষ আর জানােয়ারকে একই লাইনে ফেলছেন । ”  

“ তা কেন । জানােয়ার দেখলে মানুষের গা শিরশির করে , কিন্তু মানুষ দেখলে জানােয়ারের করে কিনা আমি জানি না । ”  

 “ অই অই , অমনি ত্যারাব্যাকা কথা শুরু হয়ে গেল । ” বলতে বলতে বিষ্টু ধর পকেট থেকে বক্তৃতা লেখা কাজগ বার করল । 

“ আমি দাগ দিয়ে রেখেছি জায়গাগুলাে । রাস্তায় রবারের বল ফাইনাল , চিফ গেস্ট বিনােদ ভড় । বুঝলেন না , ওর দলের ছেলেরা থাকবে । ফস্ করে যদি কিছু প্রশ্ন করে বসে আর যদি জবাব দিতে না পারি তাহলে আওয়াজ খাব , বেইজ্জত হব । ” 

ক্ষিতীশ কাগজটা মন দিয়ে পড়ে বলল , “ হুঁ , কী জানতে চান ? ” 

“ ওই যে লিখেছেন ' ট্যালেন্ট ঈশ্বরের দান । সেটা ফুটিয়ে তােলা যায় কিন্তু তার বদলি হিসাবে কোনােকিছুই সে জায়গায় বসানাে যায় না । যার মধ্যে ট্যালেন্ট আছে , সেটা যদি সে ব্যবহার না করে তাহলে তাকে অপরাধী হিসাবে গণ্য করতে হবে । কিন্তু আমার কথা হচ্ছে , আমাদের দেশে বহু ট্যালেন্টওলা লােক আছে , যারা শুধু খাওয়া - পরার ধান্দাতেই হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । সব আগে মানুষের দরকার বেঁচে থাকা , এটা তাে মানেন ? ” 

ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়ল । 

“ রাশিয়া - টাশিয়ার বড়াে বড়াে খেলােয়াড়দের খাওয়া - পরার চিন্তা করতে হয় না । গভরমেন তাদের গুরুত্ব স্বীকার করে , স্টেটই তাদের সব কিছু দেয় । সেই রকম আমাদের দেশেও . গভরমেনকে দেখা উচিত যাতে প্লেয়াররা খাওয়া - পরার চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে । এসব কথা একটু বলা দরকার , বুঝলেন না , পাবলিক এখন লেফটিস্ট ধরনের তাে । ”

“ কিন্তু ভারত বা বাংলা তাে কম্যুনিস্ট দেশ নয় , এখানে গণতন্ত্র । এখানে প্লেয়ারকে সব কিছুরই জন্য লড়তে হবে । গণতন্ত্রে এই স্বাধীনতাটা আছে – লড়াইয়ের স্বাধীনতা । ” 

“ আপনি কী সব কিছুরই , মানে খাওয়া - পরার জন্যও জানােয়ারের মতাে কামড়া - কামড়ি করে বাঁচতে চান ? ” 

“ মানুষ হিসেবে নিশ্চয় চাই না কিন্তু সুইমিং কোচ হিসেবে , হ্যাঁ চাই । আরামে সব জিনিস পাওয়া যায় না , বুঝলেন আপনার পাবলিককে বলবেন যে , একটা সুইমারকে খেটে , যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে উঠতে হয় । পড়ুন পড়ুন লেখাটা পড়ুন তাে । ” 

ক্ষিতীশ উত্তেজিত হয়ে বারান্দায় পায়চারি শুরু করল । বিষ্টু ধর ভীরুচোখে ক্ষিতীশের দিকে এবং বিশু - খুশির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে পড়তে লাগল – “ বিরাট বিরাট খেলােয়াড়ের গৌরবের ছটায় আলােকিত হয় তার দেশ ; যদি প্রশ্ন করি , অস্ট্রেলিয়ার কথা উঠলে সব আগে কাদের নাম আপনার মনে ভেসে উঠবে ? নিশ্চয় ডন ব্র্যাডম্যান, ডন ফ্রেজার , কেন রােজওয়ালের    নাম । যদি বলি ব্রাজিলের প্রধান মন্ত্রীর নাম কী ? পারবেন কেউ বলতে ? কিন্তু পেলের নাম আপনারা সবাই শুনেছেন । ইথিওপিয়া ছােট্ট দেশ, গরিব দেশ , অখ্যাত দেশ । কিন্তু বিকিলা যখন দৌড়াল , দেশটা বিখ্যাত হয়ে গেল । ” 

বিষ্টু ধর দম নেবার জন্য থামল । ক্ষিতীশ দাঁড়িয়ে পড়ে একমনে শুনছিল । বলল , “ কিন্তু শুধু মেডেল ধােয়া জল খেয়ে আপনার কী আমার চলবে না । মেডেল তুচ্ছ ব্যাপার , কিন্তু একটা দেশ বা জাতির কাছে মেডেলের দাম অনেক , হিরাের দাম অনেক । দেশের ছেলেমেয়েদের কাছে একজন হিরাে , সে সঁতারুই হােক আর সেনাপতিই হােক , আদর্শ স্থাপন করে । তবু ওদের মধ্যে তফাত আছে , বড়াে সাঁতারু জীবনের ও প্রাণের প্রতীক , সেনাপতি মৃত্যুর ও ধ্বংসের । সাঁতারু অনেক বড়াে সেনাপতির থেকে । যুদ্ধজয়ী সেনাপতি সমীহ পায় , আবার ঘৃণাও পায় । কিন্তু বিরাট সাঁতারু সারা পৃথিবীকে প্রেরণা দেয় । ” 

“ আপনি খালি সাঁতারু সাঁতারু বলছেন কেন , ফুটবলার ক্রিকেটার এদের নাম করুন । বাঙালিরা যা ভালােবাসে মিটিংয়ে তাই তাে        বলব । ”

“ যা খুশি বলুন , কিছু যায় আসে না । শুধু বলবেন, যারা আমাদের জন্য প্রাণ নিয়ে আসে , আমরা তাদের অবহেলা করি । ভুলে যাই তাদের খাদ্য দরকার , মাথার উপর ছাদ দরকার , খড়ের চালা যদি হয় তাও । আমরাই বাধ্য করি তাদের উঞ্ছবৃত্তি করতে । আমরাই তাদের শেখাই চালাকি করতে , মিথ্যে বলতে ।... এইসব বলার পর আপনার লাইনের কতাবার্তায় চলে আসবেন । খুব কড়া কড়া কথায় গভর্মেন্টকে এক হাত নেবেন । ”

 “ তাহলে একটু গুছিয়ে লিখে দিন । আমার যেন কেমন তালগােল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে । ”

ক্ষিতীশ ভ্রূকুটি করে তাকাল । বিষ্ণু ধর তাড়াতাড়ি বলল , “ এজন্য নিশ্চয়ই ফি দেবাে । ” 

“ ফি চাই না , একটা চাকরি চাই । যে - কোনাে চাকরি , অন্তত শ'দেড়েক টাকার । ” 

“ চাকরি !  ” বিষ্ণু ধর অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল , “ কোথায় পাব ? ” 

“ আপনার তাে ব্যবসা আছে । আমার এখন নিয়মিত টাকা দরকার । এইভাবে , বক্তৃতা তাে সারাজীবন লেখা যাবে না । ” 

“ আচ্ছা আমি দেখব’খন । ” 

আধঘণ্টার মধ্যেই ক্ষিতীশ লিখে দিল । বিষ্টু ধর চলে যাবার পর রান্না চাপিয়ে দিল । উঠোনের দেয়ালে গাঁথা বড়াে হুকে রবারের দুটো দড়ির প্রান্ত আংটায় বেঁধে আটকাবার কাজে লেগে পড়ল । রবার দুটোর অপর প্রান্তে দুটো হাতল । এই রবার পুলি টেনে ব্যায়াম করবে কোনি । কাজটা শেষ করে সে ছােটো পাশ - বালিশের মতাে চটের থােলে সের দশেক বালি দিয়ে ভরতে শুরু করল । ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়ামের সময় এই ওজন ঘাড়ে নিয়ে কোনিকে ব্যায়াম করতে হবে । 

লীলাবতী বাড়িতে ঢুকে ক্ষিতীশের কাজ দেখে অবাক হয়ে বলল , “ এগুলাে আবার যে বার করলে ব্যাপার কী ? ” 

“ কোনির জন্য । ” 

“ কে কোনি । ” 

“ একটা মেয়ে । ওকে তৈরি করব , মেয়েটার মধ্যে জিনিস আছে । একেবারে আকাঁড়া মাটি , গড়তে পারলে দারুণ সুইমার হবে । তােমাকে এনে   দেখাব । ভীষণ গরিব । ” 

লীলাবতী ঘরে ঢুকে গেল । ক্ষিতীশ ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল , “ ভীষণ গরিব , খেতে পায় না । ভাবছি এখানেই ওর খাওয়ার ব্যবস্থা       করব । ” 

ঘরের মধ্যে থেকে লীলাবতীর শুকনাে কঠিনস্বর ভেসে এল , “ ঘরটা নেওয়াই ঠিক করলাম । ওরা রাজি হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা সেলামিতে , এখন টেনেটুনে চলতে হবে বাজে খরচ একদম বন্ধ । ”

 ক্ষিতীশ আর কথা বাড়াল । বিকেলে অ্যাপােলােয় গিয়ে দেখল কোনি আসেনি । পরদিন সকালে কোনি এল আধঘণ্টা দেরিতে । ক্ষিতীশ রেগে তাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল , তার আগেই কোনি বলল , “ খাবারের বদলে বরং আমাকে রােজ একটা করে টাকা দেবেন । ” 

ক্ষিতীশের রাগটা মুহূর্তে অবাক হয়ে গেল । 

“ তার মানে ? রােজ একটা করে টাকা দিতে হবে আমাকে তুই সাঁতার শিখবি বলে ? এটা কি আমার পিতৃদায় ? ” 

“ অত খাটাবেন আর খেতে দেবেন না ? ” 

কোনির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ক্ষিতীশ হেসে ফেলল , কোনিও হাসল । দুজনের মধ্যে নিঃশব্দে যেন একটা বােঝাপড়া হয়ে গেল ।

 “ তুই একটা আস্ত শয়তান । আমাকে চিনে ফেলেছিস দেখছি । দাঁড়া , তােকে আগে সাঁতারের মজাটা পাইয়ে দি , তারপর দেখব জলে নামিস কি নামিস না । এখন আমি তােকে খাটাচ্ছি , তখন তুই খাটার জন্য পাগল হয়ে উঠবি । ” 

কোনি কথাগুলাে শুনল মুখে অবিশ্বাসের ভাব ফুটিয়ে । ক্ষিতীশ সেটা লক্ষ করে আবার বলল ,  “ লেকে একমাইল সাঁতারে যে মেয়েটার কাছে হেরেছিস , তার নাম হিয়া মিত্র । নামটা মনে রাখিস । ”

কোনির চোখ দুটো সরু হয়ে এল । মুখ ঘুরিয়ে সে কস্টুমের কাঁধের পটি ঠিক করতে লাগল ।

“ মনে রাখিস , অমিয়া বলেছে তােকে পা ধােয়া জল খাওয়াবে । ” 

কোনি ঘুরে দাঁড়াল । শীর্ণ দেহটা ঝাকিয়ে রুক্ষস্বরে বলল , “ কস্টুম সাত দিনে আমি আদায় করব । কিন্তু লাল রঙের আমি পরব না , আমার রং কালাে । ” 

অমিয়া আর বেলা পঞ্চাশ মিটার কোর্সে কিকিং বাের্ড নিয়ে প্র্যাকটিস করছে । কোনি পাড়ের কাছাকাছি । ক্ষিতীশ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। দু - চোখে শুধু অনুমােদন আর কণ্ঠে বিড়বিড় হারামজাদি কোথাকার , আমাকে নিয়ে এতদিন রসিকতা হচ্ছিল । দাঁড়া , তাের ওষুধ আমি পেয়েছি – হিয়া মিত্তির । 

“ ক্ষিতীশ , চলছে কেমন ? ” 

নকুল মুখুজ্জে রেলিংয়ে দু - হাত রেখে শুকনাে গলায় বলল , “ তুই কি কিছুই খবর রাখিস না ! বি এ এস -এর সিলেকশন । কমিটি থেকে আমাকে আউট করে দিয়েছে । এ সবই জুপিটারের ধীরেনের কারসাজি । এদিকে অ্যাপােলাের আর্থিক অবস্থাও ভালাে নয় । দু - একটা টাকাওলা লােক জোগাড় করে দিতে পারিস , প্রেসিডেন্ট করে রাখব । ” 

ক্ষিতীশের হঠাৎ মনে পড়ল বিষ্টু ধরকে । বলল ,   “ চেষ্টা করব । কিন্তু নকুলদা , বি এ এস এ থেকে আউট হয়েছ বলে দুঃখ পাচ্ছ কেন ! একটা ক্লাব ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্টেট অ্যাসোসিয়েশনের থেকে । ক্লাবই সুইমার তৈরি করে , ওরা করে মােড়লি । ” 

“ কিন্তু মােড়লদের দলাদলি ঝগড়া প্রতিপত্তির লােভ সুইমারের জীবন শেষ করে দিতে পারে । ” নকুল মুখুজ্জে হেসে উঠে বলল , “ জেনে রাখ এবার অ্যাপােলাের কেউ বেঙ্গল টিমে আসছে না , শুধু ওই দুটো মেয়ে ছাড়া । ” আঙুল দিয়ে সে অমিয়া আর বেলাকে দেখাল । “ তোরা , জেনে রাখ , সামনের বছরই জুপিটারে ফিরে যাচ্ছে । ”

নকুল মুখুজ্জে চলে যাবার পর ক্ষিতীশ আবার কোনির দিকে মন দিল ।

“ হাঁটু ভেঙে পায়ের পাড়ি ... হাঁটু ভেঙে । বলে দিয়েছি না , পা যখন পিছনে ঠেলবি তখন হাঁটু ভাঙবে , ওঠার সময় সােজা থাকবে । ” 

এই পর্যন্ত চিৎকার করে বলেই তার মনে হলাে , অমিয়া বা বেলা শুনে নিয়ে যদি এইভাবে কিকিং শুরু করে । তারপরই ভাবল , এখন আর ওদের পক্ষে আদ্যিকালের সিজার - কিক্ ছেড়ে এই শক্ত কিকিংয়ে আসা সম্ভব নয় । তা হলেও , শুনে নিয়ে ওরা হরিচরণকে বলে দিতে পারে । হরিটা অন্যদের এইভাবে শেখাবে হয়তাে । 

হাত নেড়ে ক্ষিতীশ ডাকল কোনিকে । পাড়ের কাছাকাছি আসতেই ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল , “ যা বলছিলুম হচ্ছে না কেন ? গােড়ালিটা টানটান থাকবে ... এই রকম পিছন দিকে টান করে ঠেলে রাখবি । আর কিক্ করার সময় যতটা না নীচের দিকে , তার থেকে পিছন দিকেই পায়ের ধাক্কা বেশি দিতে হবে । এইভাবে শােলান্ডার সাঁতার কেটে চারটে গােল্ড জিতেছে টোকিওয় । .... আবার কর .... সিক্স বিট , এক চক্কর হাত পাড়ি আর সেইসঙ্গে ছ'টা করে পা মারবি ... করে যা করে যা । ” 

ট্রেনিং শেষে ফেরার পথে ক্ষিতীশ জিজ্ঞাসা করল, “ তাের দাদার খবর কী রে , আসতে বলিস একদিন । দেখে যাক কেমন তুই শিখছিস । ”

কোনি জবাব দিল না । ক্ষিতীশ লক্ষ করল ওর মুখটা কেমন যেন করুণ আর গম্ভীর হয়ে উঠল । 

“ দাদার অসুখ হয়েছে । দু - দিন কাজে যায়নি । ”

 “ তাহলে তাে দেখতে যেতে হয় । আচ্ছা পরে একদিন দেখতে যাব । আর শােন আজ বিকেলে তোর ওজনটা নেব । এবার থেকে একসারসাইজ শুরু করতে হবে । খাওয়াও বাড়াতে হবে । ট্রেনিং চার্ট ডায়াট চার্ট আমি তৈরি করেছি । ভিটামিন কী কী লাগবে সেটা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব । হেমােগ্লোবিন লেভেল যদি পারি তাে টেস্ট করাব । ”

ক্ষিতীশ কথা বলতে বলতে বাজারের কাছে এসে দাঁড়াল । একটা টাকা কোনির হাতে দিয়ে বাজারের দিকে এগােচ্ছে । কোনি ভাকল – 

“ ক্ষিদ্দা , আর দুটো টাকা দেবেন ? তাহলে দু’দিন আর আমায় দিতে হবে না । ” 

“ টাকা ? কীসের জন্য ? ” ভ্রু কুঞ্চিত হল ক্ষিতীশের । 

“ চাল কিনব । দাদা তাে কাজে যেতে পারছে  না । ” 

কোনি চুপ করে গিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে রইল । 

প্রশ্ন না করে ক্ষিতীশ আরাে দুটি টাকা দিল । এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝেও গেল , প্রতিদিন ডিম - কলা খাওয়ার জন্য যে টাকা দিয়েছে সেটা কীসে ব্যয় হয় । 

ঘণ্টাখানেক পরই ক্ষিতীশ হাজির হলাে কোনিদের ঘরের দরজায় । তক্তপােশে ময়লা ছেড়া কাথার উপর কমল শুয়ে । একদৃষ্টে জানালার বাইরে তাকিয়ে । সব ছােটো ভাইটে আর মা উনুনে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির সামনে বসে । ঘরে আর কেউ নেই । ক্ষিতীশ গলা খাকারি দিতে কমল তাকাল , অবাক হলাে এবং উঠে বসতে গিয়ে দুর্বলতার জন্য টলে পড়ল । 

“ আসুন । একটু আগেই কোনি বলছিল আপনি একদিন আসবেন । কী আর দেখবেন আমায় ! " কমল চট করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল , “ দেখার আর কিছু নেই । আমি ফিনিশ হয়েই গেছি । ” 

ক্ষিতীশ তক্তপােশের ধার ঘেঁষে বসল । 

“ কী হয়েছে , ইনফ্লুয়েঞ্জা ? ” 

মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে হােসে কমল মাথা হেলিয়ে বলল , “ হ্যা । আপনি কিন্তু বেশিক্ষণ বসবেন না । ছোঁয়াচে রােগটা । ”

 “ ওষুধ খাচ্ছ ? ” 

কমল প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল , “ কোনির দ্বারা কিছু হবে কি ? ও আমাকে রােজ বলে কী কী শিখল । খুব রােখা মেয়ে । যদি বলে করব , তাহলে করবেই । ওকে দিয়ে যদি করাতে পারেন , ওর একটা ভবিষ্যৎ যদি গড়ে দিতে পারেন –  ” 

“ হবে । প্রথম প্রথম একটু চঞ্চল ছটফটে থাকে , মন বসলে আমার মনে হয় ও কিছু একটা    পারবে । ” 

“ একটা ভাইকে চায়ের দোকানের কাজে দিয়েছি , পনেরাে টাকা মাইনে । কোনিকে একটা সুতাের কারখানায় লাগিয়ে দেব ভাবছি । কথাবার্তা বলেছি , ষাট টাকা দেবে । কিন্তু ওর সাঁতার তাহলে আর হবে না । ” 

কোনি ঘরে ঢুকল । ক্ষিতীশকে দেখে অবাকই হলাে । দাদার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সে কমলের মাথায় হাত রাখল । 

“ আমি চাই না কোনি সাঁতার বন্ধ করুক । আমার নিজের খুব ইচ্ছে হতাে বড়াে সাঁতারু হব , অলিম্পিকে যাব । আমার দ্বারা কিছুই হলাে না , এখন যদি কোনি পারে । আপনি বলছেন , ওর হবে ? ” 

ক্ষিতীশ গম্ভীর স্বরে বলল , “ যদি খাটে , যদি ইচ্ছে থাকে । ” 

“ কী রে , শুনলি তাে । ” কমল মুখ উঁচু করে তাকাল । “ ইচ্ছে থাকলে মানুষের অসাধ্য কিছু নেই । ইন্ডিয়া রেকর্ড ভাঙতে হবে , তােকে । তারপর এশিয়ান , তারপর অলিম্পিক । পারবি   না ? ” 

কমলের স্বর অদ্ভুত করুণ একটা আবেদনের মতাে শােনাল । কোনির মুখে ধীরে ধীরে অস্বস্তি , তারপর চাপা ভয় ফুটে উঠল । ঘরের মধ্যে তখন কেউ কথা বলছে না । হাঁড়িতে ভাত ফোটার শব্দটা শুধু সেই মুহূর্তে একমাত্র জীবন্ত ব্যাপার । 

কমল আবার বলল , “ পারবি না ? ” 

কোনি আস্তে আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল ।


                  কোনি অষ্টম পর্ব


              পিডিএফ ডাউনলোড করুন



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে দয়া করে জানাবেন ।